পাঠোপলব্ধি
মামলার সাক্ষী ময়না পাখি
লেখক: শাহাদুজ্জামান
প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
মূল্য: ২৪০টাকা।
শাহাদুজ্জামানের ' মামলার সাক্ষী ময়না পাখি' গল্পগ্রন্থে এক স্তন্যপায়ী প্রাণীর কথা শুনিয়েছেন, যিনি গল্প লেখেন, শুনিয়েছেন এমন একজনের কথা, যাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবস্থান খুব পরিষ্কার, কিংবা যাঁর হাতে টুকরো রোদের মতো খাম, জানিয়েছেন এক চিন্তাশীল প্রবীণ বানর, এক বোধিপ্রাপ্ত উবারচালক, অপস্রিয়মাণ তিরের দিকে তাকিয়ে থাকা এক যুগল আর ওয়ানওয়ে টিকিট হাতে এক বেকুবের কথা, সেই সঙ্গে শুনিয়েছেন এক বৃহস্পতিবারের গল্প, হরিণের মতো এক নারীর গল্প, যে লবঙ্গের বঙ্গ ফেলে দেয়, এক ময়না পাখির গল্প, যে মামলার সাক্ষী দেয়, সবশেষে মুখোমুখি করেছেন দুই নাজুক মানুষকে। বইয়ের ফ্ল্যাপে এভাবেই লিখা আছে।
কিন্তু আমার পাঠোপলব্ধি এরূপ যে আমি উল্টো থেকেই শুরু করতে চাই। তাঁর যে বয়সে বইটি প্রকাশ হয়েছে তাঁর বয়েসী প্রায় সকল মানুষের, মানুষ সম্পর্কে এমন ধারণা থাকা চাই। তাতে মানুষের মনে মানুষ সম্পর্কে যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা তা কিছুটা হলেও দূর হবে। মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ব্যাথার মলম হিসেবে কাজ করবে শাহাদুজ্জামানের কথা-
"সত্যি বলতে মানুষকে আমি যত জেনেছি, তার কাছ থেকে আমি তত কম প্রত্যাশা করতে শিখেছি। যত দিন গেছে মানুষকে আমি তত সহজ শর্তে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়েছি। চলমান ট্রেনের জানালা থেকে দেখা অপস্রিয়মাণ দৃশ্যের মতো মানুষ বিষয়ে আমার ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে। প্রতিটি দিন অভ্যস্ত ধারায় কেটে যাবে ভেবেও দেখেছি, তা কেমন দিন শেষে অন্য রকম হয়ে যায়।"
ক্রাচের কর্ণেলের লেখকের সমালোচনা চলে না। 'মামলার সাক্ষী ময়না পাখি' ও তেমন। মুগ্ধ হয়ে পাঠ করে যেতে হয়। কোনো কোনো গল্পে পাঠের সুযোগই নেই। শাহাদুজ্জামান নিজের গল্প নিজেই পড়ে শোনাচ্ছেন সাদামাটা শব্দে। 'প্রোষিতভর্তৃকার ' মত কঠিন শব্দ তাঁর গল্পে নেই। তবুও খারাপ লাগে এত ভালোলাগার মাঝে। ছোট্ট একটি গল্পে দুইজন গৃহিণীকে মেরে ফেলেন লেখক। সামান্য কয়েকটা শব্দ নিশ্চিত করে একজন নারীর মৃত্যু অথচ এক বৃদ্ধের দ্বিতীয় বিবাহ হয়ে ওঠে শব্দের ভারে বলবান।
জমি মাপার আমিন যেভাবে একটি খুঁটি গেড়ে তারপর এদিক-সেদিক মাপ-ঝোঁক সেরে আবার মূল খুঁটির কাছে আসে। মাঝপথে দীর্ঘসময় অনেকের সাথে আলাপ হয়। নিজের সাথে নিজের শলাপরামর্শ হয়। শাহাদুজ্জামান এরকমই গল্পের খুঁটি গেড়ে বসে থাকেন না ঘুরে বেড়ান। পাঠকও তাঁর সাথে ঘুরে বেড়ায়। একসময় পাঠক টের পায় কথক যেখানে শুরু করেছিলেন সেখানেই আবার ফিরে এসেছেন, তখন আফসোস হয়, আরেকটু হলে ভালো হতো।
যেসব পাঠক চোখ বুলিয়ে গল্পের প্লট চিনে নিতে চান তাদের জন্য শাহাদুজ্জামান বিপজ্জনক। কারণ শব্দগুলো মোহাবিষ্ট করে বলবে পড়, দাড়ি-কমাসহ পড়। না পড়ে নিস্তার নেই। একটু পড়ুন না 'মামলার সাক্ষী ময়না পাখির' প্রথম গল্প,
'জনৈক স্তন্যপায়ী প্রাণী, যিনি গল্প লেখেন'
"স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জন্য খেলা একটা জরুরি কর্মকাণ্ড। বিবর্তনের ইতিহাস বলে, খেলা তাদের প্রকৃতিতে টিকে থাকবার সম্ভাবনা বাড়ায়। সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জন্য অতএব শৈশবে খেলা বেঁচে থাকবার, বেঁচে উঠবার একটা অপরিহার্য শর্ত। বাস্তবের নকল করে এক কপট বাস্তব নিয়ে খেলা। বাঘশাবকেরা একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কপট কামড় দেয় যেন একে অন্যের শত্রু, যেন সে শত্রুর মোকাবিলা করছে। এ নেহাত খেলা। এই খেলা তার বেড়ে উঠবার জন্য জরুরি। শিশু মানুষেরা খেলনা হাঁড়ি-পাতিলে রান্না করে, নকল মেহমান দাওয়াত দিয়ে ইটের তৈরি মাংসের তরকারি দিয়ে নকল খাওয়া খায়, তলোয়ার দিয়ে নকল যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে। এই সব খেলা তার বেড়ে উঠবার জন্য প্রয়োজনীয়। শারীরতত্ত্ববিদেরা বলছেন, এই সব পয়েন্টলেস কিন্তু ইউজফুল কাজ তার জন্য দরকার। কিছু কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণীর অবশ্য শৈশব আর ফুরায় না। তারা সারা জীবন শুধু খেলে। তারা কেবলই নকল পৃথিবীতে থাকে, বাস্তবে আর ঢোকে না। যেমন ধরা যাক কিছু মানুষ যারা গল্প লেখে। মানুষ নামের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ভেতর কেউ কেউ প্রাপ্তবয়স্ক হবার পরও গল্প লেখার মতো পয়েন্টলেস অথচ পক্ষান্তরে ইউজফুল কাজটা করে। মতিন কায়সার তেমন একজন স্তন্যপায়ী প্রাণী।"
'একজন চিন্তাশীল বানর' গল্পে প্রবীণ বানরের চেয়ে মোমেন সাহেবকে আমার সেরা চরিত্র মনে হয়। শান্ত-স্নিগ্ধ মার্জিত ইংরেজিতে দক্ষ, পদোন্নতিতে পারঙ্গম, অথচ কী নির্মম নিষ্ঠুর মোমেন সাহেব! গল্পের শেষে মৃগী বেমারি স্ত্রী আর কিশোরী কন্যাকে বলতে গেলে পরিত্যাগ করে চলে যায় আমেরিকায়, হায় ফরহেজগার!
আবার এক সময় মনে হয় ল্যাংড়া দেলোয়ারই গল্পের মূল কারিগর। চুপ-চাপ কোনো সংলাপ নেই, পঙ্গুত্বের বিলাপ নেই। নীরবে-নিভৃতে এক তীরে শিকার করেছে দুই অবলা হরিণি। এই গল্পে শহিদুল জহিরের 'মুখের দিকে দেখি' উপন্যাসের চানমিঞা চরিত্র মজেছেন শাহাদুজ্জামান আর তাঁকে পেয়ে বসেছে অথবা তিনি জেঁকে বসেছেন পুরান ঢাকার বান্দরের উপর।
অপস্রিয়মান গল্পে রয়েছে প্রত্যেক বাঙালি পরিবারের গল্প।
ছেলে বাড়ি থেকে রাগ বেরিয়ে গেছে আজ দু''দিন। কোনো খবর নেই। সাব্বির নীনা দম্পতির কাছে পুলিশের ফোন এসেছে। ভিআইপির কারণে রাস্তায় আটকে রাখলেন উদ্বিগ্ন বাবা-মাকে তাও মানলাম। কিন্তু থানার ভেতরে ঢুকতে দিয়ে হারিয়ে যাওয়া বেয়াড়া সন্তান শাহাবের কোনো খবর না দিয়ে পাঠককে বসিয়ে রাখলেন অনন্তকাল। আমরা আমাদের এই কথাগুলো বিনিময়ের জন্য শাহাদুজ্জামানের কাছে যেতে পারি। নিজেকে হালকা করে নিতে পারি। গল্পকার এজন্যেই লিখেন। পাঠকের কথা মাথায় রেখে, তাকে উদ্দেশ্য করেই লেখকের লেখা। রবীন্দ্রনাথ উত্তরসূরী শাহাদুজ্জামানের ম্যাজিক এখানেই। আর পুরা গল্প তো পড়লেনই, আমাদের নিত্যপুরাণ, ল্যাপটপ আর ট্যাব হালফিল জেন জি প্রজন্মকে না জানার খেসারত। থানার ভেতর থেকে ভালো খবর আসার সম্ভাবনা কম!
মামলার সাক্ষী ময়না পাখি গল্পের পুঁথির মজার ফাঁকে তিতা ঔষধটা গিলে নিতে হবে পাঠককে "তবে কি বজলু নিরীহ গাছি নয়? গাছের চূড়া থেকে পৃথিবীকে দেখতে দেখতে সে হয়ে উঠেছে গভীর চিন্তক? সে জেনে গেছে মানুষ অবিরাম সুতার ওপর দিয়ে হাঁটে-যার একদিকে থাকে সত্য, অন্যদিকে মিথ্যা। সে জেনে গেছে, পরিস্থিতি মোতাবেক সত্য নির্মাণ করা প্রতিভাবানদেরই কাজ।"
এ সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজের গল্পই লিখেছেন শাহাদুজ্জামান। ময়না পাখির সাক্ষী বাহানা মাত্র।
'আমি শাহাদুজ্জামান' আর 'ডাক্তার শাহাদুজ্জামানের' কথোপকথন শোনা কতটা জরুরি!
'মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার' গল্পে ডাক্তার ও রোগীর পুত্রের কথোপকথনের মধ্যে মধ্য দিয়ে অসহায় রোগীর স্বজনের কাছে ধনতন্ত্রের অপরিহার্য পরিহাস।
আমি: এই অপশনটা না থাকলে তো আমার এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো না। যদিও এই অপশন বাবাকে আবার সুস্থ করে ফিরিয়ে দেবে না।
ডাক্তার : সে সম্ভাবনা কম। তারপরও কিছু বলা যায় না।
আমি : হয়তো আরও দুই দিন, তিন দিন কিংবা দুই সপ্তাহ এই মেশিনের ভেতর থাকবে বাবা।
ডাক্তার : হয়তো তার চেয়েও বেশি, কিম্বা তার চেয়েও কম।
আমি : একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে জীবন-মৃত্যুর সীমানায় বাবা এভাবে ঝুলতে থাকবে?
ডাক্তার: তা বলতে পারেন।
আমি: তারপরও এভাবে রেখে দিলে আমি জানব যে বাবা বেঁচে আছে?
ডাক্তার: হ্যাঁ, তাই।
আমি: যদিও বাবা আমাদের মধ্যে ফিরে আসবার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে।
ডাক্তার: হ্যাঁ, সেটা ঠিক।
আমি: তবু প্রতিদিন চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব, তাই তো?
ডাক্তার : সেটা আপনি বুঝবেন।
আমি: মেডিকেল সায়েন্স জীবন-মৃত্যুর কোনো সমাধান দিতে পারছে না কিন্তু আমাদের একটা নৈতিক দ্বিধার ভিতর ফেলে দিচ্ছে, তাই না কি?
এই গল্পে ডাক্তার ও রোগীর পুত্রের কথোপকথনের মধ্যে মধ্য দিয়ে অসহায় রোগীর স্বজনের কাছে ধনতন্ত্রের অপরিহার্য পরিহাস দাঁত বের করে হাসছে।
অসাধারণ দক্ষতায় শাহাদুজ্জামান পিতাকে আইসিইউতে রেখে তাকে নিয়ে গেছেন সরিষাবািড়ীর কাছে জগন্নাথ ঘাট, পাট সংগ্রহের স্মৃতি বাংলার সোনালী আঁশের যৌবন, যমুনা নদী, হাট-বাজার, গুরুসদয় দত্তের ব্রহ্মচারী গান, ‘হান্টারওয়ালী’ সিনেমা, ব্রজবাবু সবাইকে জীবন্ত করে তুলেছেন শাহাদুজ্জামান।
সীমিত পরিসরের সকল গল্পেই বিশ্বসাহিত্যের অমৃত হতে একফোঁটা, একফোঁটা অমৃত ছুঁইয়েছেন লেখক। এই গল্পেই রয়েছে গ্রিক ভোরের দেবী ইয়োসের গল্প, দেবীর প্রেমিক মানুষ টিথোনাসের অমরত্ব লাভের আনন্দ-বেদনার কাব্য।
‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখিকে’, টিকটিকি দিয়ে চুদানো যাবে না। মুড়ি-মুড়কি নয় দু’একটা পড়লাম আর রেখে দিলাম। পাঠক হলে আপনাকে অবশ্যই পড়তে হবে বইয়ের প্রত্যেকটি গল্প। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সমৃদ্ধির সাক্ষী হয়ে রবে শাহাদুজ্জামানের কথা। আরও পড়ুন parthiv.info
পাঠক: পার্থ প্রতিম নাথ parthop93@gmail.com